এক ঘোর বরষায় সিলেট বিমান বন্দরে যখন নামলাম তখন দক্ষ পাইলট রানওয়ের একহাঁটু পানির মধ্যে প্লেন নামিয়ে দিল তখনও ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে । প্লেন থেকে নেমে দেখি এ এস পি ডি এস বি দেলোয়ার সাহেবসহ বেশ কয়েকজন ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
আসলে আমাদের আসার কথা ছিল গতকাল । প্রবল বৃষ্টির কারনে প্লেন উড়াল দেয়নি । ফলে সারাদিন এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করে আবার আমাদের ফিরে যেতে হয়েছে বাসায় । আমরা তিনজন এক কাপড়ে । আমাদের মালপত্র ট্রাক বোঝাই হয়ে চলে গেছে । আমরা বিমানে যাব । 30 মিনিটে পৌঁছে যাব বিধায় এক কাপড়ে ।
যাইহোক পানির মধ্যে পা রাখলাম । যারা নিতে এসেছিল তারা মাথার ওপর ছাতা ধরে টার্মিলালে নিয়ে আসলো । পুকিশ সুপারের পরিবার বলে দ্রুতই সসম্মানে গাড়িতে গিয়ে বসলাম এবং চা বাগানের পাশ দিয়ে শহরে ঢুকে পড়লাম। ড্রাইভার জানালো বৃষ্টি কয়েকদিন ধরে হচ্ছে থামেনি । তাই ট্রাকের মাল আনলোড করা যায়নি । গাড়ি এসে কিন ব্রিজের পাদদেশে নিল গেটের সামনে চলে এলো । গেটে বড় করে লেখা আছে পুলিশ সুপারের বাসভবন । হাউজ গার্ড গেট খুলে দিলে গাড়ি বারান্দায় থামলো । গাড়ি থেকে নেমে মন ভরে গেল । সামনেই একটা পুকুর ভরে গিয়ে টইটুম্বুর । চারিদিক দিয়ে রংগন ফুটে আছে । আর সারি সারি নারিকেল গাছ ।
বিশাল জায়গা নিয়ে বাংলো দাঁড়িয়ে আছে । ফ্রেস হয়ে দ্রুতই খেতে বসলাম। বাবুর্চি রশিদ রান্না করে রেখেছে মুরগী মাছ, ডাল ,সবজি ইত্যাদি । বৃষ্টি ততক্ষণে ধরে এসেছে । একে একে বাসার সব লোকের সাথে পরিচয় হলো । মালি হামিদ ,সুইপার মতি ,টেলিফোন ডিউটি আনোয়ার । হাউস গার্ডতো আছেই ।
বৃষ্টি ছাড়তেই অনেক লোক নিয়ে আর আই সাহেব এলেন দেখা করতে । পরিচিত হয়ে আস্তে করে বললেন , এবার আমরা চাকুরী করতে পারবো । আপনি এসে আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন । স্যার খুব কড়া । আমরাতো ভাবছিলাম আর চাকুরী করতে পারবো না । কেন জানি তারা আমাকে খুব আপন মনে করলো । এরই মধ্যে ভাবীরা চলে এলো দেখা করতে । শুরু হলো সিলেটের জীবন ।
রাতে আসল চৈতীর জ্বর । সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । বেশ জ্বর । পরদিন আমাকে মহিলা কলেজে জয়েন করতে হবে । বাড়ি ভর্তি শুধু পুরুষ কনষ্টেবল। মেয়ে ছোট । তাকে রেখে অনেক জায়গায় যেতে হবে তাই একটা মেয়ের খোঁজ করলাম। খুব দ্রুতই পুলিশ লাইন স্কুলের আয়া ফজিলাকে নিয়ে হাজির করলো ।
বয়স 17/ 18 এর মতো । গায়ের রং কালো এবং যথেষ্ট মোটাসোটা । মাথা ভর্তি চুল । থেকে গেল ফজিলা । সেই ফজিলার কথা বলতে বসেছি । আস্তে আস্তে আমি সেট হলাম । ফজিলা চৈতীর সাথে সাথে থাকে ঘরের কাজ করে দিন গড়ায় । আমি হাঁস ,মুরগী ,গরু কিনে মাছ ,সবজি চাষ করে রীতিমত গৃহস্ত বনে গেলাম। সামনে পেছনে দুটো পুকুর । প্রচুর মাছ ,বালতি ভরা দুধ , ডালা ভর্তি ডিম আর ফল ফলাদিতো আছেই । সবকিছু নিয়ে মহাব্যস্ত আমি । চাকুরী করি ,বেতারে খবর পড়ি , মাঝে মাঝে শিশু একাডেমিতে বিচারকের দায়িত্ব পালন করি । তখন অনেকবার সুলতানা কামাল আপার সাথে দায়িত্ব পালন করার সৌভাগ্য হয়েছে ।
দিন যায় ,মাস যায় ,বছর গড়ায় । আমাদের চলে আসার সময় হয় । সমস্যায় পড়ি ফজিলাকে নিয়ে।
ফজিলার বাড়ি ময়মনসিংহ । বাবা নাই । মায়ের মাথায় গন্ডগোল আছে সুস্থ নয় আরকি । বোন আছে সে পঙ্গু । ফজিলার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই । এরমধ্যে আমার হ্যাসবেন্ড গেছে ইংল্যান্ড ট্রেনিং করতে । মেয়ে নিয়ে আমারও যাবার কথা । এখন কি করি চিন্তায় পড়ে গেলাম । ইংল্যান্ড থেকে ফিরেই ঢাকায় চলে যেতে হবে ।
অনেক ভেবে একদিন আর আই সাহেবকে ডেকে পাঠালাম । উনি এলে তাকে সব কথা জানালাম । বললাম একটা ছেলে ঠিক করেন এবং তাকে চাকুরী দিতে হবে যে ফজিলাকে বিয়ে করবে । ওনার ওপরে দায়িত্ব দিলাম। তিনি খুঁজে বের করলেন মান্নান নামে একটি ছেলেকে । মান্নানের বাড়িও ময়মনসিংহ । খুব ছোট থেকে পুলিশ লাইনে থাকে । ট্রাকে করে ফোর্স যেখানে ডিউটি করে সেখানে ভাত পৌঁছে দেয় । আমার এখানেও নাকি আসে গার্ডদের খাবার নিয়ে । আমি দেখিনি । যাইহোক এখন দরকার চাকুরী । আর আই সাহেব অনেক ঘাটাঘাটি করে একটা চাকুরী বের করলেন ,সেটা হচ্ছে পুলিশ হাসপাতালে পানি বহনকারী । সরকারি পদ । বেতন ,রেশন সব সরকারি নিয়ম অনুসারে পাবে । খুব খুশী হলাম । মান্নানকে বলা হল বিয়ে করলে তাকে চাকুরীটা দেয়া হবে । সে রাজি হয়ে গেল । ইংল্যান্ড থেকে ফিরে বিয়ে দিলাম সেই সাথে চাকুরী ।
এর আগেও বিভিন্নভাবে মানুষের পাশে সাধ্যমত থেকেছি বা থাকি কিন্তু এতবড় কাজ করা এবারই প্রথম । ভয় পাচ্ছিলাম । পরে যদি মান্নান ফজিলাকে না দেখে । টিন কিনে সরকারি জায়গায় ঘর তুলে দিলাম । বিছানা বালিশ হাড়িপাতিল যতটুকু সম্ভব দিলাম । আর দিলাম একটা রিকশা কিনে যার আয় ফজিলা নেবে । ঢাকায় চলে আদার সময় হাঁস মুরগী ঘর সহ দিয়ে আসলাম। ফজিলার বিয়ের কাবিননামা এখনো আমার কাছে ।
আমার মেয়ে বড় হচ্ছে আমিও চাকুরীর সাথে অনেক কাজ করছি । ফজিলার একে একে তিনটি ছেলেমেয়ে হয়েছে । তারা বড় হয়ে গেছে । বড় মেয়েটি অনার্স পাশ করেছে কদিন আগে । ছেলেটি অনার্সে পড়ে , আর সব ছোটটি এস এস সি দিচ্ছে । মজার ব্যাপার হলো ফজিলা বা মান্নান কেউ লেখাপড়া জানে না একেবারেই । শুধু নাম লিখতে পারে । আমিই শিখিয়েছি । মান্নান নিয়মিত ফোন করে খবর জানায়। আমি সবসময় বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতে বলেছি । নিজের খুব ভালো লাগে ওদের কথা শুনে ।
একটা চাকুরী দেয়ার ফলে একটা শিক্ষিত পরিবার তৈরি হয়েছে । আমার চেষ্টা বিফলে যায়নি । অথচ কত পরিবার আছে যাদের বাচ্চারা লেখাপড়া করে না। এই সাফল্যটাই সবসময় আমায় অনুপ্রাণিত করেছে ,করে সাধ্যমত অন্যের পাশে দাঁড়াতে ।
ফজিলার মেয়ে এখন চাকুরীর চেষ্টা করছে । ইচ্ছাই ফজিলাদের এগিয়ে দেয় । সঠিক পথ মানুষকে ভালো কিছু দেয় বলেই আমার বিশ্বাস । মান্নান যদি চাকুরী পাবার পর শয়তানি করতো তাহলে বাচ্চাদের লেখাপড়া হতো না । আজ তাহলে ফজিলাকে নিয়ে লেখাও হয়তো হতো না । ফজিলারা এভাবেই এগিয়ে যাক আরো অনেক পথ ।
18 .11 .2021
উত্তরা ।
Comments