বাড়িতে এলেই ৫/৬ বছরের আমাকে দেখি । যে বয়সের কথা বলছি সেই সময়ে আমরা এখানে থাকতামনা । এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে থাকতাম । আম ্লিচু পাকলে ,পাড়ার সময় বাড়িতে আসা হতো । আর আসা হতো দূর্গা পূজার সময় । মেলা বসতো বট গাছের চারপাশ দিয়ে । সাথে ছোট যমুনা নদী । তখন নদী শাসন করে বুকের ওপর বাঁধ হয়নি । ফলে মেলা আর নদী ছিল একই সমান্তরালে অর্থাৎ পাশাপাশি । নৌকায় দূর্গা পুত্র কন্যা নিয়ে লতা ,সতীনাথ ,সন্ধ্যার গান শুনতো । আজ যখন নদীর বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে শুকনো ছোট যমুনা দেখছিলাম তখন আমার কানে বাজছিল "নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা
------।
বট গাছটি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে । এই বিদ্যালয়টি ১৯০৬ সালে আমার দাদা আনোয়ার আলী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । লোকে তাঁকে তাঁর জ্ঞানের জন্য পন্ডিত বলে ডাকতো । আর এখনো আমাদের পন্ডিতের নাতি বলে ডাকে । স্কুলটি তখন মাটির ছিল । এখন এটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় । সুন্দর দালান হয়েছে । বটের ঝুরি নেমেছে । বট গাছটির বয়স কেউ বলতে পারেনা । অনেক বয়স্ক মানুষের কাছে আব্বারা শুনেছে তারাই বলেছেন যে ছোট থেকেই তারা এই গাছ দেখছেন । শতবর্ষী মানুষেরাও বলে আসছেন ,তারাও গাছটিকে এভাবেই দেখে আসছেন । তাই কেউ বলতে পারেন না বট গাছটির বয়স কত ! জেলা শহর নওগাঁ থেকে গাছটির মাথা নাকি দেখা যেতো । রবিউলের কাছে জানতে চাইলে সে বললো ,একবার গাছের মাথায় উঠেছিল । সেখান থেকে নওগাঁর উচুঁ দালান কোঠা দেখতে পেয়েছে ।
নদীর পানি অনেকটা দূরে সরে গেছে বুক জুড়ে চর পড়েছে । নানান ফসলের সমারোহ । বর্ষায় অবশ্য নদীর বুকে উপচে পড়ে । নদীও চলে আসে বাঁধের গা ঘেঁষে ।
মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল মাটির তৈরি ছেলে পুতুল ,মেয়ে পুতুল ,হাতি ,ঘোড়া আরো কত কি । চিনির তৈরি এইসব জীব জন্তুও ছিল । আর ছিল একটা মজার গাড়ি । ঢোলের মত একটা জিনিসের সাথে চাকা লাগানো থাকতো ওপরের অংশে দুটো কাঠি থাকতো । সামনে সুতো দিয়ে বাধা । সেটি ধরে টানলে কাঠি দুটো ঢোলের ওপর বারি দিলে টক টক করে বাজতো । সেটা খুবই পছন্দের ছিল ।
মেলায় আসার সময় ৪/৫ টাকা হাতে পেতাম নিজের পছন্দ মতো জিনিস কেনার জন্য । আব্বার সাথে মেলায় যেতাম মাঠের মধ্যে দিয়ে । আমাদের মতো লাইন ধরে মানুষ যেত ।
মেলায় গিয়ে প্রথমেই পুতুল কেনা তারপর অন্যকিছু । ছোট ছোট চুড়ি কিনতাম লাল নীল । রান্নাবাটি খেলার জন্য ছোট ছোট মাটির হাড়িপাতিল ,কড়াই কত কি । বাঁশি কিনে ফু উ উ । সারা মেলা সেই শব্দে মুখরিত । পোঁ ও ও ---।
সেই পথেই ফিরতে হতো । যাওয়ার সময়ে উচ্চস্বরে সবাই বলতো , মেলায় যাচ্ছি । আর ফেরার সময় গলার স্বর মিইয়ে যেতো একেবারে । কেউ কোথায় গেছি জানতে চাইলে ,গলা খাদে নেমে বলতো সবাই ,মে-লায় ।
আজ আবার যখন এসে দাঁড়ালাম মেলার শূন্য জায়গায় । ছোট্টবেলা এক ঝটকায় সামনে চলে এলো । পুতুলের শাড়ি ,জামা । মাটির হাড়িপাতিল দিয়ে মিথ্যে মিথ্যে রান্না বাটি খেলা । পুতুল বিয়ে । সব সবকিছু চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে ।
আমি এদিক ওদিক হাঁটতে থাকি । খুঁজতে থাকি হারিয়ে যাওয়া সময় । খুব ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছে করে । কত মধুর ছিল রঙিন ছিল সেইসময় । হাঁতড়াতে থাকি স্মৃতির এলব্যাম। ছবিগুলো একটুও ঝাপসা হয়নি । সন্ধ্যা হয়ে আসছে । বটের পাতায় রাতের ছোঁয়া । শীতের বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে গেল । হ্ঠাৎ দেখি অনেকটা পথ ফেলে এসেছি। ফিরি ,ফিরতে হয় । মন আমার খুঁজতে থাকে হারিয়ে ফেলা মাটির পু -তু-ল ।
ফেরদৌসী পারভিন
উত্তরা
২০২৩
Comments