বাড়ি এসেছি । আমাদের বাড়ির সীমানা শেষ হলে বাঁধ ঘেসে মহন্তদের বসবাস । আমি যতদূর জানি এরা বৈষ্ণব মতের অনুসারী । শুনলাম ওদের একটা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে বেশ ঘটা করে। মেয়ের বাবা স্বর্নকার । সারাগ্রামে দাওয়াত দিয়েছে । আমরাও বাদ যাইনি । রাত আটটায় লগ্ন । গেলাম বিয়ে দেখতে । বর পুলিশের চাকুরী করেন।
বিয়ে খুব ঘটা করে হচ্ছে । সনাতন ধর্মের মানুষের বিয়ে খুব কালারফুল তাই দেখতে আসা ।
রাতে গেলাম । বর মন্ডপে বসেছে । কনেকে আনা হলে বিয়ের কার্যক্রম শুরু করলেন পুরহিত । বিয়ে নিয়ে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয় । আমি কনে রত্নর কথা বলতে চাইছি ।
রত্ন সবে স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়েছে । পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠার আগেই তাকে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে । তারমানে এখনো রত্নর মেয়েবেলা শেষ হয়নি । আমি অবশ্য জানিনা তার মেয়েবেলা কেমন ছিল! একসময় পূন্যের জোয়ারে ভেসে যেত মেয়েশিশু । গৌরী দানের চক্করে পড়ে আর চৌদ্দ পুরুষের স্বর্গ নিশ্চিত করতে মেয়েশিশুর মেয়েবেলা আসার সুযোগ পেতনা । কন্যার শৈশব খুঁজে দেখতে পাওয়া যায়না তার পিত্রালয়ে । কারণ তখন সে শশুরবাড়ির ঘেরাটোপে আটকে গেছে । মেয়েবেলা বলে কিছু নেই । বাংলা সাহিত্যেও ভারতচন্দ্র পর বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত শত বছরের বেশি সময় মেয়ে শিশুরা মেয়েবেলায় পা দিতে পারেনি । শাঁখা সিঁদুরে হারিয়ে গেছে মেয়েবেলা ।
রত্নকে দেখে আমার মনে হলো সে-কি আজকের পর দুদিন আগের তার জীবনটাকে ফিরে পেতে চাইবে কখনো? তার বন্ধুরা যখন দলবেঁধে কলেজে যাবে , অকারণে একে অপরের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়বে। কিংবা নতুন প্রেমের কথা বন্ধুদের সাথে ভাগ করে লজ্জা লজ্জা মুখে তাকাবে । তখন রত্ন কি ঐ জীবনের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলবে ? গয়না ,টোপর ,বেনারসি চন্দনে কনে রত্নকে খুব ভালো লাগছে দেখতে । মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী । সারাবাড়িতে লোকজন গিজগিজ করছে একটা ঘরে কনের সাজে রত্ন বসে আছে । আমি দেখতে চাইলে ওর মা আমাকে ঘরে নিয়ে গেল । সাজানো খাটে লাল চেলিতে অপূর্ব লাগছে । ছবি নিলাম । রন্ত হাসিমুখে পোজ দিল । আমি কয়েকমিনিট কথা বললাম । আমার মেয়েটিকে খুব ক্লান্ত মনে হল । এদের অবশ্য বিয়ের দিন অনেকটা সময় উপোস থাকতে হয় । সে কারণেও হতে পারে ।
আমি বেরিয়ে এলাম ।
ফিরতে ফিরতে মনের মধ্যে অনেক কথার প্রশ্ন তৈরি হল ।
মেয়েটির আজ থেকে মেয়েবেলা শেষ হয়ে গেল । শুরু হলো বৌবেলা । সংসার নামক বিরাট ভার মাথায় স্থাপিত হলো । এ সংসার শুধু স্বামী -স্ত্রী নিয়ে নয় । সেখানে শশুর শাশুড়ি ,ননদ , দেবর ,ভাসুর ,জা সবার মন জয় করে এবং সবার সেবা যত্ন করে আদর্শ বৌ হওয়া যায় । তারপর পুরুষ নামক ব্যাক্তিটি নিজের অনেক দায় স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেয়। তার মন যোগাতে না পারলে সংসার সমূদ্র পাড়ি দিতে জীবন কয়লা হয়ে যাবে । হাবুডুবু খাবে কিন্তু ডুবে মরবে না । শুধু মরার অনুভূতি হবে । সেটা যে কত ভয়াবহ তা যে ভোগ করে সে -ই শুধু জানে। আমৃত্যু সেই যন্ত্রণা ভোগ করে যেতে হবে ।
যাপিত জীবনের দিবা রাত্রি খেলায় ছেড়ে যাওয়া সাথীদের কথা মনে করে ফিরে পেতে চাইবে? বন্ধুদের জন্য বুকের মধ্যে তোলপাড় করবে কাঁচা আমের ঝাল নুনে মাখা জিভে জল ঝরানো দুপুর ! আমি জানিনা । শুধু জানি সময় হবার আগেই অন্য সময়ে পা দিয়ে ফেলেছে মেয়েটা বাবা মায়ের ইচ্ছেই। এখন গৌড়ীদান করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ স্বর্গে যেতে চায়না ঠিকই কিন্তু মেয়েবেলা ছিনিয়ে নিয়ে দায়িত্ব মুক্ত হয় । কখনো বাবা নামক পুরুষ ভেবে দেখেনা কি মহামূল্যবান একটা সময় তার মেয়ের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে । মেয়েটার শরীর মন যুদ্ধের জন্য সম্পুর্ণ প্রস্তুত না হতেই এক অসম যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ! প্রতিদিন বলি হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য মেয়ের মেয়েবেলা ।
কখনো কি রত্ন মেয়েবেলার জন্য আফসোস করবে ???
ফেরদৌসী পারভিন
উত্তরা
২৮.১.২০২৪
Comments